কলেজের যাবতীয় ফি দিয়ে ভর্তি হয়েছেন, নিয়মিত ক্লাস, পরীক্ষা সবকিছুতেই অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার দিনে জানতে পারলেন তারা শিক্ষার্থী নন। ভর্তি প্রক্রিয়ায় প্রতারণার শিকার হয়েছেন তারা। আর অভিযোগের তীর যার দিকে, সেই অফিস সহকারী ঘটনার আঁচ পেয়ে কলেজ থেকে সটকে পড়েছেন।
ঘটনা বগুড়া সরকারি শাহ সুলতান কলেজের। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে প্রতারণার শিকার চার শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে এসব জানা যায়। গতকাল তাদের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছিল। তারাও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আশা নিয়ে কলেজে এসেছিলেন। কিন্তু অংশগ্রহণ করতে পারেননি।
ওই চার শিক্ষার্থীর দাবি, অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে এমন প্রতারণা করেছে কলেজের কয়েকজন অফিস সহকারী। কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীর ভুয়া ভর্তির ঘটনা স্বীকার করলেও তাদের সঠিক সংখ্যা বলতে পারেনি।
অভিযুক্ত অফিস সহকারীর নাম হারুনুর রশিদ। তিনি মাস্টার রোলে কলেজে কর্মরত এবং কলেজের পরীক্ষা কার্যক্রম কমিটির সদস্য। তার নামে বিগত সময়ে একাধিকবার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে কলেজে। তিনি ছাড়াও এই প্রতারণার কর্মকাণ্ডে আমিনুল ইসলাম, আব্দুল হান্নান নামে আরও দুই সহকারী।
কলেজ প্রাঙ্গণে কথা হয় বগুড়া সদরের সাবগ্রাম এলাকার রাশেদুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি এসএসসি পরীক্ষায় পাশের পর সরকারি শাহ সুলতান কলেজে মানবিক শাখায় ভর্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। তবে ভর্তি প্রক্রিয়ার নিয়ম অনুসারে তার সিরিয়াল আসে করোনেশন স্কুল এন্ড কলেজে। কিন্তু তিনি ভর্তির বিষয়ে জানতে শাহ সুলতান কলেজের অফিসে যোগাযোগ করেন। ওই সময় তার কথা হয় অফিস সহকারী হারুনুর রশিদের সঙ্গে।
তিনি দাবি করেন অফলাইন পদ্ধতিতেও ভর্তি হওয়া যাবে। তার কথামতো ৬ হাজার টাকা দেন রাশেদুল ইসলাম। এই ফি পরিশোধের রশিদও তাকে দেয়া হয়। ভর্তির পর তার শ্রেণি রোল দেয়া হয় ১৫৭৫। এরপর রাশেদুল নিয়মিত ক্লাস করেন। অংশ নিয়েছেন প্রাক নির্বাচনী ও নির্বাচনী পরীক্ষায়।
রাশেদুল ইসলাম বলেন, আমাদের ভর্তির সময় টাকা নিয়েছে। এরপর কলেজের শোল্ডার ব্যাজ, পরীক্ষার জন্য টাকা নিয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষার জন্য ৬ হাজার টাকা দিয়ে ফরম ফিলাপও করেছি। অথচ প্রবেশপত্র নিতে এসে দেখি আমরা শিক্ষার্থী না। হারুন ভর্তি হওয়ার সুযোগ আছে এমন আশ্বাস দেয়ার কারণে আজ প্রতারণার শিকার হলাম।
অন্য শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও একই রকম অবস্থা। হারুনুর রশিদ তাদের সবার কাছে থেকে ভর্তির নামে টাকা নিয়েছেন।
প্রতারণার শিকার শারমিন আক্তার নামে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা তো কলেজের নিয়ম অনুসারে সব করেছি। ভর্তির পর আমরা একাধিক বার হারুনের কাছে কাগজপত্র চেয়েছি। কিন্তু তিনি তোমরা তো ভর্তি হয়েছো। ক্লাস করো, কাগজ দিয়ে কি করবা। একেবারে এইচএসসি পরীক্ষার পর নিও।
হাবিবা আক্তার নামে এক শিক্ষার্থীর মা হাসিনা বানু আক্ষেপ নিয়ে বলেন, কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি ভর্তির নামে প্রতারনা করেন। তাহলে বাচ্চারা কীভাবে বুঝবে? আর আমারসহ এতগুলো মানুষের সন্তানের দুই বছর জীবন থেকে নষ্ট হয়ে গেল তার কী হবে? এই বিচার কে করবে?
কলেজের ছাত্রলীগের কর্মীসহ একাধিক শিক্ষার্থীরা জানান, যখন থেকে অনলাইনে ভর্তির প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, তখন থেকেই হারুনুর রশিদ এই অপরাধ করে আসছিল। বিষয়টি অনেকেই জানতেন। কিন্তু তাকে কিছু বলা হতো না। ভর্তি প্রতারণার কর্মকাণ্ডে তার সঙ্গে হান্নান, আমিনুলও জড়িত। এর আগে হারুন গনিত বিভাগের অফিস সহকারী ছিলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছে অনৈতিকভাবে টাকা নেয়ার অভিযোগে তাকে সেখান থেকে বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু তাকে চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়নি।
কলেজ সবার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছর এইচএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের সময় পাঁচ থেকে সাতজন একই রকম প্রতারণা শিকার শিক্ষার্থীকে পাওয়া যায়। তবে ওই সময় কলেজের শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় তাদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। তাদেরও ভর্তির পিছনে হারুনুর রশিদের হাত ছিল।
কলেজ শিক্ষার্থীদের দাবি, কলেজ স্টাফদের একটি সিন্ডিকেট গোপনে এসব প্রতারণার কাজ করে বেড়াচ্ছে। হারুন ছাড়া এই সিন্ডিকেটে অফিসের বড় বাবু তাজমিলুরসহ একাধিক ব্যক্তি জড়িত।
শাহ সুলতান কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান বলেন, গতকাল বুধবার থেকে আমরা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীদের পেয়েছি, যারা পরীক্ষার প্রবেশপত্র নিতে এসে ঘুরে গেছে। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি তাদের সঙ্গে প্রতারণার কথা। এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা অন্তত ২০ জন হবে। কলেজ অধ্যক্ষ যদি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা রাখতে পারেন অফিস সহকারীরা এসব প্রতারণার সুযোগ জীবনেও পাবে না।
এ বিষয়ে মোবাইলে জানতে চাইলে হারুনুর রশিদ সব অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি কারও কাছে টাকা নেইনি। টাকা আমিনুলেরা নিতে পারে। এ বিষয়ে আপনারা বড় বাবুর সঙ্গে কথা বলেন।
আমিনুল ইসলামের খোঁজ মিলেনি কলেজে। তবে অফিস সহকারী আব্দুল হান্নানের দেখা পেলে জিজ্ঞেস করা হয়। তিনি বলেন, আমি শুধু একজনের কাছে ৮ হাজার টাকা নিয়েছি। সেটাও হারুনকে দিয়েছি কাজ করার জন্য। এটা আমার ভুল হয়ে গেছে।
কলেজের প্রধান সহকারী (বড়বাবু) তাজমিলুর রহমান বলেন, আমি এসবের সঙ্গে জড়িত না। এসব টাকা নেয়ার কাজ হারুনেরা করেছে। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন যারা টাকা দিছে তাদের কাছে কোনো মূল রশিদ নেই। আমার ক্যাশ মিলিয়ে দেখেন কোনো অনিয়ম পাবেন না।
শাহ সুলতান কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক মোহাম্মদ আইয়ুব আলী এসব ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ওই শিক্ষার্থীরা দুই বছরে কখনও কোনো শিক্ষকের কাছে আসেনি। তাহলে হয়তো এই অবস্থায় পড়া লাগতো না।
আর হারুনুর রশিদের বিষয়ে মোহাম্মদ আইয়ুব আলী বলেন, এর আগে অনৈতিক কাজে বরখাস্ত হয়েছিল। সে সময় তিনি এমন অপরাধ আর করবেন এ মর্মে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু একই ধরনের অভিযোগ আবার তার বিরুদ্ধে উঠেছে। এ জন্য আমাদের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে সবোর্চ্চ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. রেজাউন নবী বলেন, আমি কয়েক মাস হলো এখানে এসেছি। আমি বিগত সময়ের ঘটনা বলতে পারবো না। তবে ভর্তির নামে প্রতারণার ঘটনায় লিখিত অভিযোগ দিলে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর এই শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বোর্ডে যোগাযোগ করা হবে। এবার হয়তো আর কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু আগামিতে যাতে পরীক্ষা দিতে পারে সে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করা হবে।
No comments:
Post a Comment