৩০ ওভার পেরিয়ে গেছে তখন, পাকিস্তান উইকেট হারিয়েছে মোটে একটি। বাংলাদেশের কিপার চিৎকার করে বললেন, “সহজেই ছেড়ে দিও না, লেগে থাকো।” এরপরও ক্যাচ পড়ল, সুযোগ হাতছাড়া হলো। কিন্তু বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা ঠিকই লেগে থাকল, দারুণ লড়াইয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং স্নায়ুর চাপকে হারিয়ে শেষ পর্যন্ত জয় আদায় করেই ছাড়ল। স্বপ্নের বিশ্বকাপ অভিযানে প্রথম জয়!
মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে এই ম্যাচকে ঘিরেই বাংলাদেশের আশা ছিল সবচেয়ে বেশি। সম্ভাবনাগুলো ব্যাটে-বলে পূর্ণতা পেল মাঠের ক্রিকেটে। উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচে বাংলাদেশ জিতে গেল ৯ রানে।
ছেলেদের ক্রিকেটে প্রথম বিশ্বকাপে ১৯৯৯ সালে স্কটল্যান্ডকে হারানোর পর পরাক্রমশালি পাকিস্তানকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। মেয়েরাও প্রথম বিশ্বকাপে হারাল পাকিস্তান।
হ্যামিল্টনের ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে সোমবার বাংলাদেশ ৫০ ওভারে তোলে ২৩৪ রান। ওয়ানডেতে যা তাদের সর্বোচ্চ দলীয় রান।
টানা দ্বিতীয় ফিফটিতে ফারজানা হক করেন ৭১, অধিনায়ক নিগার সুলতানার ব্যাট থেকে আসে ৪৬। তৃতীয় উইকেটে দুজনের দুর্দান্ত জুটির রান ৯৬। একাদশে ফিরে ওপেনার শারমিন আক্তার খেলেন ৪৪ রানের ইনিংস।
রান তাড়ায় ওপেনার সিদরা আমিনের সেঞ্চুরির পরও পাকিস্তান যেতে পারে ২২৫ রান পর্যন্ত।
দীর্ঘসময় পর্যন্ত অবশ্য জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়ে রেখেছিল পাকিস্তান। সিদরা আমিনকে অন্তত চারবার ফেরানোর সুযোগ হাতছাড়া করে বাংলাদেশ। ৪১ ওভার শেষেও ৮ উইকেট বাকি ছিল পাকিস্তানের, স্রেফ বলপ্রতি রান করলেই চলত। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্বে নিগার সুলতানা কাজে লাগান দুই লেগ স্পিনার রুমানা আহমেদ ও ফাহিমা খাতুনকে। ৫ রানের মধ্যে ৫ উইকেট নিয়ে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। সেই ধাক্কা আর সামাল দিতে পারেনি পাকিস্তান।
নিগার সুলতানা ও ফারজানা হকের ৯৬ রানের জুটি বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয় রেকর্ড রানের পথে।
নিগার সুলতানা ও ফারজানা হকের ৯৬ রানের জুটি বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয় রেকর্ড রানের পথে। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে ফাহিমা নেন ৩ উইকেট। ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়া সেই স্পেলে ম্যাচের সেরা তিনিই।
ওয়ানডেতে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের টানা তৃতীয় জয় এটি, তিনটিই দেশের বাইরে।
সেডন পার্কে টেস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ শুরু করে প্রথম ওভারে শামিমা সুলতানার দুর্দান্ত কাভার ড্রাইভের বাউন্ডারিতে। তিনি আর শারমিন আক্তার সাবলিল ব্যাটিংয়ে এগিয়ে নেন দলকে। ৮ ওভারে আসে ৩৬ রান।
আগ্রাসী হওয়ার চেষ্টায় শামিমা নবম ওভারে বিদায় নেন ১৭ রান করে। তবে এক ম্যাচ বাইরে থাকার পর একাদশে ফিরে শারমিন দারুণ খেলতে থাকেন। এবার তার জুটি গড়ে ওঠে ফারজানা হকের সঙ্গে।
দারুণ কিছু শট খেলে শারমিন এগিয়ে যান ফিফটির দিকে। তবে আলগা শটে বিদায় নিয়ে পঞ্চাশ তার হয়নি। অফ স্পিনার ওমাইমা সোহেলের লেগ স্টাম্পে থাকা ফ্লাইটেড বল সুইপ করতে গিয়ে আউট হন তিনি ৬ চারে ৫৫ বলে ৪৪ রান করে।
সেই ধাক্কাও বাংলাদেশ সামাল দেয় দারুণভাবে। ইনিংসের সেরা জুটি গড়ে তোলেন দলের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটার ফারজানা ও অধিনায়ক নিগার।
শুরুতে সাবধানী ব্যাটিংয়ে এক-দুই রান নিয়ে এগোতে থাকেন দুজন। সময়ের সঙ্গে বাড়ে ব্যাটের ধার ও রানের গতি।
১২৪ বলে ৯৬ রানের এই জুটি ভাঙে নিগারের বিদায়ে। ফাতিমা সানার অফ কাটারে বাংলাদেশ অধিনায়ক এলবিডব্লিউ হন ৬৪ বলে ৪৬ রান করে।
ফারজানা অবশ্য ফিফটি পেয়ে যান এর আগেই। আগের ম্যাচেই বাংলাদেশকে প্রথম ফিফটি উপহার দিয়েছিলেন তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। সেই ম্যাচে ৫২ রানে আউট হলেও এ দিন এগিয়ে যান আরেকটু। রুমানা আহমেদও ক্রিজে গিয়ে দ্রুত রান তুলতে শুরু করেন।
তবে শেষটা করতে পারেননি দুজনের কেউ। ১৩ বলে ১৬ করে রুমানা ক্যাচ দেন মিড অফে। নবম ফিফটিতে ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ৭১ করে ফারজানা ধরা পড়েন উইকেটের পেছনে।
শেষ দিকে দ্রুত রান তুলতে পারতেন যিনি, সেই ফাহিমা খাতুন আউট হন প্রথম বলেই। শেষ দিকে রিতু মনি ও সালমা খাতুনও খুব দ্রুততায় রান তুলতে পারেননি। সম্ভাবনা জাগিয়েও তাই আড়াইশ ছুঁতে পারেনি বাংলাদেশ। তবে মেয়েদের ক্রিকেটে পাকিস্তানের জন্য ২৩৫ রানের লক্ষ্যও ছিল বেশ বড়। রান তাড়ায় শুরুটা করে তারা দুর্দান্ত। নাহিদা খান ও সিদরা আমিন উদ্বোধনী জুটিতেই দলকে নিয়ে যান শতরানের কাছাকাছি। রানের গতি খুব ভালো না হলেও দলকে ভালো ভিত গড়ে দেন দুজন।
৯১ রানের উদ্বোধনী ২৪তম ওভারে ভাঙেন রুমানা আহমেদ। ৪৩ রান করে নাহিদা খান স্টাম্পে টেনে বাইরের বল।
দ্বিতীয় উইকেটে সিদরা আমিন আরেকটি ভালো জুটি গড়েন বিসমাহ মারুফের সঙ্গে। এই জুটিতে আসে ৬৪ রান।
বোলিংয়ে শুরুটা ভালো করতে না পেরে ফিল্ডিংয়েও কিছুটা খেই হারায় বাংলাদেশ। সিদরা আমিন প্রথমবার জীবন পান ২৩ রানে, সালমা খাতুনের বলে। এরপর ৪৮, রানে, ৫৪ রানে ও ৬০ রানে আবার সুযোগ দেন তিনি, প্রতিবারই রিতু মনির বলে। কোনোটিই নিতে পারেনি বাংলাদেশ। বিশেষ করে, ৬০ রানের সময় সহজতম ক্যাচ ছাড়েন ফারজানা।
বারবার বেঁচে গিয়ে সিদরা এগিয়ে যান শতরানের পথে। তবে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় স্পেলে ফেরা জাহানারা আলমকে স্লগ করতে গিয়ে পাকিস্তান অধিনায়ক বিসমাহ আউট হন ৩১ রানে।
এরপর লেগ স্পিন দিয়ে পাকিস্তানকে পর্যদুস্ত করে বাংলাদেশ। ওমাইমা সোহেলকে ফেরানোর পর ফাহিমা পরপর দুই বলে আউট করেন বিপজ্জনক আলিয়া রিয়াজ ও ফাতিমা সানাকে। পাকিস্তানের আরেক ভরসা নিদা দারকে শূন্যতেই শেষ করেন রুমানা। ৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে পাকিস্তান অনেকটা ছিটকে পড়ে পথ থেকে।
সিদরা আমিন তবু চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু পাকিস্তানকে বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরি উপহার দেওয়ার পর তিনি বিদায় নেন রান আউটে। শেষ সময়ে স্নায়ুর চাপ সামলে ম্যাচ জিতে আনন্দ নৃত্যে মেতে ওঠেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ২৩৪/৭ (শামিমা ১৭, শারমিন ৪৪, ফারজানা ৭১, নিগার ৪৬, রুমানা ১৬, রিতু ১১, ফাহিমা ০, সালমা ১১*, নাহিদা ২*; ফাতিমা সানা ১০-০-৫৪-১, ডায়না ৫-১-৩২-০, নিদা ১০-০-৪৫-১, নাশরা ১০-০-৪১-৩, গুলাম ফাতিমা ৭-০-৩০-০, ওমাইমা ৮-১-৩১-১)।
পাকিস্তান: ৫০ ওভারে ২২৫/৯ (নাহিদা ৪৩, সিদরা আমিন ১০৪, বিসমাহ ৩১, ওমাইমা ১০, আলিয়া ০, ফাতিমা সানা ০, সিদরা নওয়াজ ১, ডায়না ১২, নাশরা ৯*, গুলাম ফাতিমা ৫*; জাহানারা ৪-০-২০-১, তৃষ্ণা ৪-০-১৯-০, সালমা ৯-০-২৯-১, নাহিদা ৯-০-৪৮-০, রুমানা ৭-০-২৯-২, রিতু মনি ৯-০-৪২-০, ফাহিমা ৮-০-৩৮-৩)।
ফল: বাংলাদেশ ৯ রানে জয়ী।
প্লেয়ার অব দা ম্যাচ: ফাহিমা খাতুন।
No comments:
Post a Comment